বর্তমান সময়ে চশমা বিকল্পে দ্রুত ও সহজতম সমাধান হিসেবে ল্যাসিক একটি বহুল প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি। এই অপারেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি একজন ব্যক্তিকে চশমার ঝামেলা থেকে দেয় নিমিষেই মুক্তি । চশমাজনিত সমস্যার সমাধানে একজন ব্যক্তির জীবনে ল্যাসিক এক পরম আশীর্বাদ।

ল্যাসিক কি?
ল্যাসিক (LASIK- Laser Assisted in Situ Keratomileusis) চশমা বিকল্পে প্রযুক্তগিত উৎকর্ষের এক অত্যাধুনিক আবিষ্কার।এটি এক অত্যাধুনিক চক্ষু লেজার প্রযুক্তি যা এক্সাইমার লেজারের সাহায্যে করা হয়। ল্যাসিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত এক্সাইমার লেজার আমাদের চোখের একেবারে সামনে কর্নিয়ার মাঝখানের এক চতুর্থাংশ থেকে এক তৃতীয়াংশ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পাতলা করে দেয়। এটি এমনই এক প্রযুক্তি যাতে চোখের বাইরে বা চোখের মধ্যেও কোনো লেন্স বসান হয় না।

ল্যাসিক করাতে হাসপাতালে থাকতে হয় না, অজ্ঞান করা হয় না, এমন কি কোন ইনজেকশন বা ব্যান্ডেজও দিতে হয় না। শুধু ড্রপ দিয়ে চোখ অবশ করে ল্যাসিক করা হয়। দুই চোখে ল্যাসিক করতে সময় লাগে মাত্র ৫ থেকে ৭ মিনিট যদিও আসল লেজার সময় মাত্র কয়েক সেকেন্ড প্রতি চোখে। আধ ঘন্টা পরই রোগী বাসায় যেতে পারে। অপারেশনের পরদিন চোখ দেখে কেউ বলতেও পারবে না যে অপারেশন হয়েছে।


ল্যাসিক কারা করতে পারবে?
নিম্নলিখিতক্ষেত্রে ল্যাসিক সার্জারি বিবেচনা করা হয়ঃ
  • যাঁদের বয়স ১৮ বছরের ওপর;
  • যাঁদের চশমার পাওয়ার -১.০০ বা + ১.০০ এর ওপর এবং বিষম দৃষ্টি -৬.০০এর মধ্যে
  • যাঁদের চোখে রেটিনা, কর্নিয়ায় সমস্যা বা অন্য কোন অসুখ নেই
  • গত ১ বছরের মধ্যে চশমার পাওয়ার বাড়েনি
  • অন্তঃসত্ত্বা নয় (মহিলাদের জন্য) ;
  • যাঁরা চশমা বা কন্ট্যাক্ট লেন্স পরতে চান না
ল্যাসিকের সাহায্যে নিম্নলিখিত পাওয়ার কারেকশন করা সম্ববঃ


প্রস্তুতি এবং সার্জারি পূর্ববর্তী আলোচনা
অপারেশনের পূর্বে আপনি ল্যাসিক করানোর জন্য উপযুক্ত কিনা সেটি নিশ্চিত করার জন্য চোখের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ত্রুটিবিচ্যুতি নির্ণয়ে বিশেষ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা টেস্ট করা হয়। এই টেস্ট রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নেন রোগীর চোখে ল্যাসিক করা যাবে কিনা অথবা ল্যাসিক করা গেলেও কতটুকু পাওয়ার কারেকশন করা যাবে।

ল্যাসিক সারজারিরক্ষেত্রে চশমার পাওয়ার, কর্নিয়ার পূরুত্ব, কর্নিয়ার ধরনসহ আরও নানাবিধ বিষয় মূখ্য ভূমিকা পালন করে। টেস্টপরবর্তীকালে ডাক্তারের সাথে আলোচনায় উপোরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও রোগীর পেশা ও শখের বিষয়গুলো বিবেচনা করে একজন সার্জন তাঁর রোগীর পাওয়ার কারেকশনের সিধান্ত নিয়ে থাকেন। ডাক্তারের সাথে আলোচনার সময় আপনার পূর্ববর্তী চশমার প্রেসক্রিপশনগুলো সাথে রাখা জরুরী।

টেস্ট এবং টেস্টপরবর্তীকালে নিম্নলিখিত পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করা হয়ে থাকেঃ

  • রোগীর চোখে একটি ড্রপ দিয়ে চোখের মণি বড় করে চোখ পরীক্ষা করা হয় যাতে রেটিনার স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা হয় এবং সেই সাথে চশমার পাওয়ার পরীক্ষা করা হয়।
  • চোখের চাপ বা প্রেশার (গ্লকোমা) আছে কিন সেটি নিশ্চিত করা হয়।
  • এছাড়াও রোগীর চোখের কর্নিয়ার আকার পরিমাপ করা হয় এবং কেরাটোকোনাস (কর্নিয়ার একপ্রকার অসুখ) আছে কিনা বা ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা সেটাই যাচাই করা হয়।

  • আপনি যদি কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহারকারী হন তবে টেস্টের কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে থেকে তা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবেন।

    টেস্টপরবর্তীতে যদি প্রতিয়মান হয় যে আপনি ফেমটো-ল্যাসিক সার্জারির জন্য উপযুক্ত নন তাহলেঃ
  • আপনার ডাক্তার আপনাকে বিষদভাবে জানাবেন কেন আপনি যোগ্য নন
  • আপনি তখন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে আপনি অন্য কোন রিফ্র্যাক্টিভ সার্জারি করাতে চান, না কি আপনার চশমা বা লেন্সের ব্যবহার চালিয়ে যাবেন।

কিভাবে আপনি সার্জারির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবেন?
যদি আপনি কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহারকারী হন, তাহলে বেশির ভাগ সার্জনই আপনাকে সার্জারির আগের কয়েক সপ্তাহ লেন্সের পরিবর্তে চশমা পড়তে বলবেন। সার্জারির নির্ধারিত দিনে কোন প্রকার মেক আপ, লোশন বা সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে না। আপনার সাথে অবশ্যই আরো একজনকে সাথে আনতে হবে যিনি সার্জারির পর আপনাকে বাড়ি নিয়ে যাবেন।

সম্মতিপত্র:
সার্জারি সম্পর্কিত সব রকম সুবিধা, বিকল্প পদ্ধতি ও সম্ভাব্য জটিলতা সম্পর্কে অবহিত করার পর আপনাকে একটি সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করতে বলা হবে।
ল্যাসিক কিভাবে করা হয়ঃ
ল্যাসিক সার্জারি দুটি ধাপে সম্পন্ন করা হয় যাতে আমরা জার্মানির বিশ্ববিখ্যাত Carl Zeiss এর MEL-90 লেজার প্রযুক্তি ও সুইজারল্যান্ডের AMADEUS II মাইক্রোকেরাটম প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকি।

প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া সমূহঃ

  • ল্যাসিকের পূর্বে চোখে যে এন্টিবায়োটিক ড্রপ ব্যবহার করতে বলা হয় তা অপারেশনের আগেরদিন থেকে ৬ঘন্টা অন্তর দৈনিক ৪ বার ব্যবহার করতে হবে।
  • অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার পর আপনাকে লেজার মেশিনের বেডে শুয়ে পড়তে বলা হবে।
  • অনুভূতিনাশক আইড্রপ আপনার চোখে দেওয়া হবে।
  • চোখের পলক যেন না পড়ে সে জন্য একটি আইলিড হোল্ডার ব্যবহার করা হবে।
  • যে চোখটি সার্জারি করা হবে না সেটি একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে।
  • ল্যাসিক অপারেশনের প্রথম পদক্ষেপ মাইক্রোকেরাটমের সাহায্যে চোখের কর্নিয়ায় একটি ফ্ল্যাপ তৈরি করা হবে। এ সময় চোখের উপর একটু চাপ লাগবে এবং আপনি কয়েক সেকেন্ড সবকিছু ঝাপসা দেখবেন কিন্তু কোনো ব্যথা পাবেন না। আপনার কাজ হবে কোনোদিকে চোখ না ঘুড়িয়ে স্থীরভাবে তাকিয়ে থাকা।
  • এই পর্যায়ে চোখের কর্নিয়ায় তৈরিকৃত ফ্ল্যাপটি ইন্সট্রুমেন্টের সাহায্যে তুলে একপাশে সড়িয়ে রাখা হবে।
  • তারপর সার্জন আপনাকে লেজারের সবুজ আলোর এবং শব্দের সাথে পরিচিত হতে বলবেন এবং দু’একবার on / off করে বুঝিয়ে দেবেন।
  • এবার লেজার মেশিন চালিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী ১৫ থেকে ৬০ সেকেন্ডের মধ্যে লেজার রশ্মির সাহায্যে চশমার পাওয়ার কারেকশন করা হবে। এই সময়টা লেজারের target lightএর দিকে শান্তভাবে একভাবে তাকিয়ে থাকা এবং সার্জনের নির্দেশনা অনুসরন করা অত্যন্ত প্রয়োজন এবং আপনার একমাত্র কাজ।
  • লেজার প্রয়োগ শেষ হলে চোখ ধুয়ে পরিষ্কার করে কর্নিয়ার সেই সড়িয়ে রাখা ফ্ল্যাপটি আবার নামিয়ে দেয়া হবে এবং অপারেশন শেষ করা হবে।
  • এই পুরো অপারেশনে কোন প্রকার ইনজেকশন, সেলাই বা ব্যাণ্ডেজ ব্যবহার করা হয় না
সার্জারির পরবর্তী ধাপসমূহ
  • সার্জারীর পরপর আপনার চোখে আইড্রপ দেওয়া হবে
  • এরপর নার্স আপনাকে বিশ্রাম করার জন্য একটি বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে যাবেন
  • এরপর সার্জন আপনার চোখ স্লিট ল্যাম্প দিয়ে পরীক্ষা করে দেখবেন
  • আপনার ওষুধ গুলো ঠিকমতো বুঝিয়ে দিয়ে আপনাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে
  • অপারেশনের পরপরই আপনার চোখ লাল হতে পারে, চোখ দিয়ে পানি পড়তে পারে, কারো কারো সামান্য মাথা-ব্যাথা অনুভুত হতে পারে তবে এ সবকিছুই স্বাভাবিক। মাথা-ব্যাথার জন্য প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক পেইনকিলার ট্যাবলেট খেতে পারেন।
  • সার্জারীর পর আপনি কিছুটা আলোক সংবেদনশীল হতে পারেন এবং সরাসরি আলোর দিকে তাকাতে প্রথম প্রথম সমস্যা হতে পারে।এজন্য বাইরে ক’দিন সানগ্লাস ব্যবহার করা ভাল, কিন্তু বাসায় থাকলে তার প্রয়োজন নেই।
  • • এছাড়াও অপারেশনের পর আপনার চোখ সামান্য খচ খচ করতে পারে তাই বাড়ি গিয়ে পারলে ৫-৬ ঘণ্টা ঘুমান খুব জরুরী তাতে অপারেশন পরবর্তী অস্বস্তিবোধ কেটে যাবে। তবে, কোনোভাবেই চোখ কচলানো যাবেনা । কারণ চোখ কচলানোর ফলে অপারেশনের সময় চোখের কর্নিয়ায় যে লেয়ারটা তোলা হয় তা কোন কারনে সরে গেলে দৃষ্টিগত সমস্যা হতে পারে এবং আসস্তিবোধ বাড়তে পারে।
  • অপারেশনের দিন দৃষ্টি কিছুটা ঝাপসা থাকতে পারে তবে পরদিন সকালে সেটা থাকেনা বললেই চলে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রমও হতে পারে।
  • কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আপনার চোখ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে
  • সব ওষুধ ও আইড্রপগুলো সময় ও নিয়ম-মেনে ব্যবহার করা চোখের দ্রুত সেরে উঠতে খুবই জরুরী।
  • আমরা আমাদের রোগীদেরকে সার্জারি পরবর্তী এক বা দুইদিন বাড়িতেই থাকতে বলি, না হলে চোখে ধুলাবালি চলে যেতে পারে। এছাড়া দৈনন্দিন কাজ যেমন লেখাপড়া, টিভি দেখা, কম্পিউটারে কাজ করা এসব কাজ সার্জারির পরদিন থেকেই করা যায়।
  • কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত খেলাধুলা এবং চোখে জোড়ে পানির ঝাপটা দেয়া যাবেনা।
  • চোখে আঘাত লাগতে পারে এমন যে কোন খেলাধুলা থেকে কয়েক সপ্তাহ বিরত থাকা উচিৎ।
  • অপারেশনের পরদিন থেকে গলার নিচ হতে গোসল করা যায়
  • দৃষ্টি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত সপ্তাহ দু’এক বা কারো কারো ক্ষেত্রে মাসখানেক চোখে দৃষ্টি সামান্য ওঠা-নাম করতে পারে, এটা স্বাভাবিক। অনেকক্ষেত্রে চোখে শুষ্কভাব মনে হতে পারে, এক্ষেত্রে ডাক্তার আপনাকে যে আর্টিফিশিয়াল টিয়ার ড্রপ ব্যবহার করতে বেলেছেন সেটি ব্যবহার করতে হবে। এই শুষ্কভাব অনুভূত হওয়ার কারণ হচ্ছে, অপারেশন পরবর্তী সময়ে চোখের অশ্রু গ্রন্থিগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। এই অবস্থা পরে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়। এছাড়া যদি চোখে অন্য কোন সমস্যা হয় তাহলে রোগীর উচিৎ দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা।যারা ঢাকার বাইরে থাকেন তাঁরা তাঁদের নিকটস্থ চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া।
অপারেশনের পরদিন অবশ্যই ডাক্তারের কাছে ফলো-আপের জন্য আসতে হবে। পরবর্তী ফলো-আপগুলো সপ্তাহে বা মাসে হতে পারে। তবে এই ফলো-আপগুলো নিয়ম মেনে রক্ষা করা আপনার চোখের দ্রুত সেরে ওঠার জন্য সহায়ক।

করণীয়
  • অপারেশন শেষে বাড়ি ফেরার সময় অবশ্যই সাথে একজন সঙ্গী থাকা
  • বাড়ি ফিরে কয়েকঘন্টা ঘুমানো ভালো, কেননা এ সময় চোখের বিশ্রাম খুবই জরুরী
  • ডাক্তারের পরামর্শ সঠিক ভাবে সাবধানে অনুসরণ করা
  • অপারেশন শেষে বাসায় ফেরার সময় চোখে একটি সানগ্লাস ব্যবহার করুন।
বর্জনীয়
  • ধুলাবালি বেশি এমন জায়গাগুলোতে কিছু দিন যাওয়া
  • ডাক্তার অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত গরম পানিতে গোসল বা সাঁতারকাটা
  • চোখ কচলানো বা চুলকানো
  • ছ’সপ্তাহ পর্যন্ত ডুব দিয়ে গোসল করা।
  • ২ সপ্তাহ পর্যন্ত চোখের মধ্যে বাইরের পানি দেয়া
  • ২-১ সপ্তাহ মেক আপ ব্যবহার করা এবং ড্রাইভিং করা
  • চোখে আঘাত লাগতে পারে এমন যে কোন খেলাধুলা থেকে কয়েক সপ্তাহ বিরত থাকা উচিৎ।
  • যাদের ছোট বাচ্চা আছে তারা বাচ্চা কোলে নিলে সাবধানে থাকবেন যাতে চোখে বাচ্চার হাতের খোঁচা না লাগে।
  • কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত খেলাধুলা না করা, চোখে জোড়ে পানির ঝাপটা দেয়া যাবেনা তবে অপারেশনের পরদিন থেকে গলার নিচ হতে গোসল করা যায়
  • অপারেশন শেষে বাসায় ফেরার সময় যদি গাড়ি ব্যবহার করেন তবে গাড়ির জানালার কাঁচ লাগিয়ে দিন। যারা ঢাকার বাইরে যাবেন তাঁরা বাসের বা ট্রেনের জানালার পাশের সিটে বসবেন না। যাত্রা বিরতির সময় যেখানে বাস থামে সেখানে পারতপক্ষে নামবেন না। আর বিশেষ প্রয়োজনে যদি নামতে হয় তবে বাস থামার ৫ থেকে ১০ মিনিট পরে নামবেন। যেখানে বেশী লোকজনের সমাগম হয় সেসব জায়গা এড়িয়ে চলুন।